টুকরে টুকরে গ্যাং'-এ ভেঙে মহারাষ্ট্রের রাজনীতি! ভোটে তার কতটা ফায়দা তুলতে পারবে বিজেপি

Lok Sabha Election 2024: এবারে মহারাষ্ট্রে নরেন্দ্র মোদিরা যাঁর উপরে সবচেয়ে ভরসা রাখবেন ভেবেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন হলেন একনাথ শিন্ডে। অন্যজন অজিত পাওয়ার।

ভরা গ্রীষ্মের দুপুরেও বিরাম নেই ভোট প্রচারে। খামতি নেই কর্মীদের উদ্যমে। মহারাষ্ট্রের বারামতি শহরের ঠিক মাঝখানে নটরাজ নাট্য মন্দির। শ্রমিক সংগঠনের সভায় বক্তব্য রাখতে আসবেন রাজ্যের উপ-মুখ্যমন্ত্রী। বিশেষ কোনও আড়ম্বর নেই। গেটের সামনে একটি বড় ব্যানার আর মঞ্চের উপর একটি। কিন্তু গেটের সামনে ক্রমাগত ব্যান্ড পার্টির বাজনা বেজে চলেছে। একে একে নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা আসছেন ও সভাগৃহ ভরে উঠছে।

আগত নেতা-কর্মীদের অভিবাদন জানাতে জানাতেই সঞ্চালকের চঞ্চলতা জানান দিল তিনি এসে পড়েছেন। মঞ্চে এলেন অজিত পাওয়ার। স্লোগানেরও খুব আড়ম্বর নেই। হুমড়ি খেয়ে পড়লেন এলাকার ছোট-বড় নেতারা। সবার হাতে একটা না একটা দরখাস্ত। একটুও বিচলিত না হয়ে তিনি একটির পর একটি দরখাস্ত পড়লেন। যথাযথ নির্দেশ দিলেন। কিছু দরখাস্ত সই করে তুলে দিলেন সহকারীর হাতে।

তিনিই এখন বারামতির মধ্যমণি। তিনিই হতে চাইছেন এখানকার 'বিকাশপুরুষ'। কাকা শরদ পাওয়ারকে ঘোল খাইয়ে এনসিপি দল ভেঙেছেন। আগামী প্রজন্মের নেতা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে চাইছেন। মূল দলের কর্তৃত্ব ও প্রতীক নিজের হাতে রেখেছেন। এবার লক্ষ্য নিজের স্ত্রী সুনেত্রা পাওয়ারকে বারামতি লোকসভা কেন্দ্র থেকে জেতানো ও বোন তথা শরদ পাওয়ারের কন্যা সুপ্রিয়া সুলেকে হারানো। তাই তিনি হাত মিলিয়েছেন বিজেপির সঙ্গে।

আরও পড়ুন: বাংলার একপেশে রাজনীতি বিজেপিকে জায়গা করে দিল । মুখোমুখি দীপঙ্কর ভট্টাচার্য

কিন্তু দু'একজন নেতার বক্তৃতার পরেই তিনি যখন বলতে উঠলেন, হাসি-ঠাট্টায় মেশানো ৪০ মিনিটের ভাষণে কাকা শরদ পাওয়ারকে নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না। বরং বারামতি কেন্দ্রের জন্য (তিনি এই কেন্দ্রেরই এনসিপি বিধায়ক) তিনি কী কী উন্নয়নের কাজ করেছেন, কোন কারখানা নিয়ে এসেছেন এখানে, কোন শিল্পপতিকে জায়গা দিয়েছেন, আর কোন কোন কাজ তিনি করতে চান — তার ফিরিস্তি দিয়ে গেলেন। সঙ্গে বললেন, গ্রামের একজন পঞ্চায়েতের প্রধানের বিরুদ্ধেও যেখানে দুর্নীতির অভিযোগ উঠে থাকে, সেখানে নরেন্দ্র মোদিই একমাত্র নেতা এবং এমন একজন প্রধানমন্ত্রী যাঁর বিরুদ্ধে কোনও দুর্নীতির অভিযোগ নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের কোন কোন প্রকল্প থেকে মহারাষ্ট্রের মানুষ উপকৃত হয়েছেন ও হতে পারেন, তারও ফিরিস্তি দিলেন। তিনি কী ভাবে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে উন্নয়নের জোয়ার বজায় রাখতে পারবেন তার দাবিও করলেন।

নরেন্দ্র মোদিরাও অজিতের উপরে তাঁদের বাজি রেখেছিলেন। নরেন্দ্র মোদিকে 'দুর্নীতি-মুক্ত' নেতা বললেও, অজিত নিজের ঘাড়ে ৭০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। ইডি-সিবিআইয়ের সঙ্গে তাঁর নিত্য দেখা-সাক্ষাৎ চলছিল। কিন্তু দল ভেঙে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে হাত মেলাতেই আপাতত 'সাত খুন মাফ'! কাকা শরদ পাওয়ারের মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতের যে আধিপত্য রয়েছে তা খর্ব করতে পারলেই হয়ত আরও বড় পুরস্কার মিলবে।

এবারে মহারাষ্ট্রে নরেন্দ্র মোদিরা যাঁর উপরে সবচেয়ে ভরসা রাখবেন ভেবেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন হলেন একনাথ শিন্ডে। যিনি শিবসেনা ভেঙে মূল শিবসেনার ক্ষমতা নিজের হাতেই রেখেছেন এবং বিজেপির সমর্থনে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও হয়েছেন। আর দ্বিতীয়জন এই অজিত পাওয়ার। কিন্তু অচিরেই এনডিএ-র এই দুই জোট সঙ্গীকে নিয়ে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহদের মোহভঙ্গ হয়েছে। তাঁরা বুঝতে পেরেছেন নির্বাচন আরও বেশি কঠিন হয়েছে তাঁদের জন্য।

অজিত পাওয়ার যে শরদ পাওয়ারের একছত্র আধিপত্য খর্ব করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন, তা বোঝা যায় অজিতের বক্তব্য থেকেই। তাঁর বক্তব্য বারামতি-কেন্দ্রিক। বারামতিরই সোমেশ্বরনগরে শরদ পাওয়ারের এনসিপি দলের একজন স্থানীয় নেতার কথায়, "অজিত দাদা তো বারামতির বাইরে কিছুই করতে পারবেন না। তিনি শুধুই বারামতির নেতা হয়ে থেকে গেছেন। এর বাইরে তাঁর কোনও প্রভাব নেই!"

আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এই নেতা শরদ পাওয়ারের পক্ষ নিয়েই তো কথা বলবেন। কিন্তু যে নরেন্দ্র মোদি ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে মাত্র খান দশেক সভা করেছিলেন, সেই মোদিই যখন মহারাষ্ট্রের তৃতীয় দফা নির্বাচনের আগেই এক ডজন প্রচার সভা করে ফেলেন, তখন তো বুঝতেই হবে চাপ আছে। অজিত-একনাথ বা মহারাষ্ট্রের বর্তমান উপ-মুখ্যমন্ত্রী ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিজেপির দেবেন্দ্র ফড়নবীশের উপর ভরসা রাখতে পারছেন না।

সেটা অস্বাভাবিক নয়। উত্তরপ্রদেশের পরে মহারাষ্ট্রেই সবচেয়ে বেশি আসন। ৪৮টি আসনের মধ্যে শিবসেনার সঙ্গে জোট করে ২০১৯ সালে ৪১টি আসন পেয়েছিল বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ জোট। বিজেপির নিজের স্ট্রাইক রেট দুর্দান্ত ছিল — ২৫টি লড়ে ২৩টি আসনে জয় পেয়েছিলেন বিজেপির প্রার্থীরা।

এবারের লড়াই যদিও দু'টি জোট — মহায়ুতি ও মহা বিকাশ আঘারির মধ্যে। কিন্তু মহারাষ্ট্রের রাজনীতিকে টুকরে টুকরে করে দিয়েছেন মোদি-শাহরা। শরদ পাওয়ারের এনসিপি ও উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনাকে টুকরো টুকরো করেছেন তাঁরা। কাজেই অবিভক্ত শিবসেনা তাঁদের জোটসঙ্গী নয় এবার। বিভক্ত এনসিপি-ও খুব সাহায্য করছে না বিজেপিকে। দেবেন্দ্র ফড়নবীশরা ভেবেছিলেন এর ফলে বিরোধীদের শক্তি ক্ষয় হবে এবং অজিত ও একনাথের কাঁধে ভর করে তরী পার করবেন তাঁরা।

কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে শিবসেনা ও এনসিপি-তে ভাঙন হলেও এবং দু'টি দলের দুটি গোষ্ঠীই একে অপরের থেকে কতটা শক্তিশালী তা প্রমাণ করতে ব্যস্ত থাকলেও, নীচু তলার সমর্থকেরা এই 'টুকরে টুকরে গ্যাং'কে ভালো ভাবে নেননি। শরদ পাওয়ার ও বালাসাহেব ঠাকরের পুত্র উদ্ধব ঠাকরের সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা হয়েছে বলে মনে করছেন এনসিপি ও শিবসেনার সমর্থকদের একাংশের। আর সেই বিশ্বাসঘাতকতায় মদত দিয়েছে বিজেপি। এমনই মত এই সমর্থকদের।

তার উপর এমন ভাবে বিজেপি দুর্নীতিতে অভিযুক্ত নেতাদের দলে নিয়েছে, যে মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে দুর্নীতি কোনও ইস্যুই হয়ে উঠছে না। তাঁরাও যে ভাবে শিবসেনাকে ভেঙে উদ্ধব ঠাকরেকে সরিয়ে একনাথ শিন্ডেকে মুখ্যমন্ত্রী করেছেন, তাতে শরদ পাওয়ার ও উদ্ধব ঠাকরের হাত মিলিয়ে ২০১৯-এ মহারাষ্ট্রে সরকার গড়াকেও কাঠগড়ায় তুলতে পারছে না বিজেপি নেতৃত্ব। আর উন্নয়ন তো শিবসেনার নেতৃত্বে মহাবিকাশ আঘারির সরকারও করছিল। মোদি আর কত নতুন কথা বলবেন! মোদির হিন্দুত্বের কথা তো উদ্ধবও বলেন। সুতরাং ইস্যু খুঁজে পাওয়া কঠিন হচ্ছে বিজেপি নেতাদের। একই সঙ্গে পেঁয়াজ রফতানি করার উপর কেন্দ্রের নিষেধাজ্ঞা (যেটি খুব দেরি করে সম্প্রতি তুলতে বাধ্য হয়েছে কেন্দ্র) রুষ্ট করেছে মহারাষ্ট্রের কৃষকদের।

এই গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো যোগ হয়েছে প্রার্থী বাছাইয়ে জটিলতা। টুকরো হয়ে যাওয়া দলে প্রার্থীর দাবিদার অনেকে। জোটসঙ্গীকে কোন আসন ছাড়া যাবে আর কোনটি ছাড়া যাবে, কে প্রার্থী হবেন এবং কে হবেন না, সেই হিসেব নিকেশ করতেই অনেক সময় পেরিয়ে গিয়েছে।

আরও পড়ুন:প্রশ্ন তুলছে সুরাট-ইন্দোর, এক দেশ এক ভোট এলে ভোটাধিকার থাকবে আদৌ?

আর এই সব কারণেই মহারাষ্ট্রের দৈনিক পত্রিকা লোকসত্ত্বার সম্পাদক গিরীশ কুবেরের কথায়, ভয় চেপে বসেছে বিজেপির মনে। উত্তর প্রদেশের পরে সবচেয়ে বেশি আসন যে রাজ্যে রয়েছে, সেই মহারাষ্ট্রের উপর যদি নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে না পারেন মোদি-শাহরা তবে '৪০০ পারের' ধারে কাছে পৌঁছাতে বেগ পেতে হবে বিজেপিকে।

তবে একটি ব্যাপার লক্ষ্য করার মতো। নরেন্দ্র মোদি সারা মহারাষ্ট্র চষে বেড়াচ্ছেন। এনসিপি ও শরদ পাওয়ারের শক্ত ঘাঁটি পুণে জেলার পুণে শহরে এসেও সভা করে গেছেন তিনি। কিন্তু পুণে জেলারই অন্যতম লোকসভা কেন্দ্র এবং পাওয়ার-পরিবারের গড় বারামতিতে কোনও সভা করেননি তিনি। হয় তিনি অজিত পাওয়ারের বারামতি আসন জেতানো নিয়ে সন্দিহান অথবা তিনি সাহেব-পাওয়ারের জন্য দরজা খোলা রাখছেন।

More Articles